পাথথর-না-চুনি

লহার জাং পাসের পর চরাই পথটাতে হান্টার জুতটার সোলটা খুলতে শুরু করল। প্রথমে খুব অল্প সামনের দিকটা  ফাঁক দেখা জায়। সাধারণ অবস্থায়ে এটা তেমন বড় ব্যাপার নয়, মুচির কাছে ২০৳ দিয়ে শাড়িয়ে নিলেই হয়। কিন্তু এখানে তো মুচি বা জুতোর দোকান নেই। এই রাস্তায়ে জুতো ছিরে গেলে খুব বিপদ। এই কথা ভেবে টক্কর বসে পরল পথের পাশে একটা পাথরের উপর। পিঠের রুক-শাক থেকে একটা নাইলন দরির কিছুটা কেটে নিয়ে সেটা দিয়ে শক্ত করে জুতটা বাধল। পেছনে স্মরজিত আসছিল, পাশে দারিয়ে পরল।

“কি রে টক্কর – বশে পরলি যে?” স্মরও প্রশ্ন করল।

“কেলও হয়ে গেছে – আমার জুতোর সোলটা মনে হয় খুলে আস্তে পারে” বলল টক্কর।

টক্করের ভালো নাম গৌতম, আর স্মরজিত কে বন্ধুরা ছোট করে স্মরও ডাকে। সামনে পাহাড়ি পথে কিছু আগে ওদের আরও দুই বন্ধু পার্থ বসু আর বুজু। পার্থ আর বুজু মেকানিকাল ৩য় ইয়ারের ছাত্র, স্মরও সিভিল আর টক্কর আরকিটেকচার। অরা সবাই জাদাভপুর বিশ্ববিদ্যালয়র ছাত্র। পুঁজর ছুটিতে রুপকুন্ড ট্রেক করছে। ওদের ট্রেকের আজ দিতিও দিন। গতকাল সকালে হেটে ওরা পউছেছিল থারলিতে। ছোট পাহাড়ি গ্রাম থারলি। থারলি পউছাতে শেষ এক ঘণ্টা পথ চরাই। ওই চরাই রাস্তাটা খুব জরে হেঁটেছিল টক্কর। ইচ্ছে সবার আগে থারলি পৌছবে। ওর সামনে বুড় গাইড বীর সিং – তাকে পাশ কাটিয়ে টক্কর এগিয়ে গেছিল।

“হাম আগে জাতা হায়ে, আপ পিছে আইয়ে।”

“জালদি মাত কিজিয়ে – বাবুজি – পর্বত বাহুত উঁচা হায়ে” বীর সিং মুচকি হেসে বলেছিল।

সেই উপদেশটা যে মানলেই ভাল করত সে কথা টক্কর টের পেল আরও আধ ঘণ্টা পরে। পা বুক  যেন জ্বলে যাচ্ছে। ওরা শহুরে ছেলে – পাহাড়ে উঠবার দম তইরি হয়নি। ওদের মধ্যে পাহাড়ে চরার অভিজ্ঞতা একমাত্র বুজুর আছে, কলেজের মউন্তেনিয়ারিং ক্লাবের সদস্য। ওদের বছরে একবার নিয়ে যায়ে পুরুলিয়াতে রক ক্লাইম্বিং শিখতে ক্লাব থেকে। তা ছাড়া বুজু রোজ ঢাকুরিয়া লেকের বড় লেকটা একবার চক্কর মারে। টক্কর আর এক পাও এগোতে পারবে না। এমনিতে বিড়ি টানা দম – নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হওয়ার জোগাড়। ওকে বসে পরতে হল পথের ধারে। একটু পরে বুজু ওকে পাশ কাঁটালো। টক্করের অবস্থা দেখে বুজু হাসল। বুজুর পিছনে বীর সিং – সেও ওকে পাশ কাঁটালো। যাবার সময়ে টক্করকে উৎসাহ দিয়ে বলল –

“আউর জাদা নেহি বাবুজি, থোরা রাস্তা বাস।”

আরও কিছু পরে পার্থ আর স্মরও, সব শেষে পিছনে ওদের কুলি কুয়ারি সিং। আর বসে থাকা চলে না – অল্প ইজ্জত বাচাতে হবে। টক্কর উঠে পরল। থারলিতে প্রথম রাতটা ওরা কাটিয়ে ছিল পাঠশালার বারান্দায়ে। বীর সিং এই অঞ্চলে সবাইকে চেনে। ওদের কাছে তাঁবু নেই শুনে সব থাকবার ব্যবস্থা সেই করেছে। রাতে খাওয়া শেষে, আগুনের সামনে বসে বীর সিং পরের দিনের যাত্রা বুঝিয়ে দিয়েছিল। সকাল সকাল থারলি থেকে বেরিয়ে ওরা লহার জাং পাসের চরাই পার হবে। লহার জাং পেরিয়ে ওরা দুপুর বেলা পউছাবে বইদিনি বুগিয়াল। সেখানে অল্প বিশ্রাম আর নাস্তা করে এগিয়ে চলবে পাথথর-না-চুনির দিকে।

“রাত কো কাঁহা রোকেঙ্গে”? বুজু প্রশ্ন করল।

বীর সিং আগুন থেকে একটা কাঠি দিয়ে বিড়ি জালিয়ে উত্তর দিল “বইদিনি মে গরমেন্ট কা মাকান হায় – লেকিন  উ তো পেহেলে সে বুক কারনা পরতা। আপ লগকো উসসে আচ্ছা জাগা হাম লে চলেঙ্গে”। কুয়ারি সিং অল্প কথার লোক, পাশে বসে হাত সেকছিল। ফোড়ন কাটল “হাওয়া মহল”। গরমেন্টের তইরি হাওয়া মহলে থেকে কাজ নেই – কিন্তু বীর সিং ওদের রাখবে কথায়ে?

“আপ লগকো হাম জাএগে পাথথার না চুনি – এক গুম্ফা হায়ে। উস গুম্ফে মে হাম লগ রাত ঠেরেঙ্গে। আভি সব সো জাইয়ে কাল সুবে সুরাজ কে পেহেলে নিকাল না হায়ে।”

গুহাতে রাত কাটানো – উত্তেজনায়ে অনেক্ষন টক্করের ঘুম হয় আসেনি।মাটির দালানের সামনে আগুন জ্বেলে শীতটা একটু রোকা গেছে, তবুও ঠাণ্ডা কনকনে। তার উপর মাটিতে শোবার অভ্যাস নেই। অনেক এলো মেলো কথা ভাবতে ভাবতে – আর কালো আকাশে অজস্র তারা দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে পরল টক্কর নিজেয় টের পায়নি।

এই হল বইদিনী বুগিয়াল

এসব গেল কালকের কথা। আজ লহার জাং পাস টপকাতে গিয়ে ওর হান্টার জুতটা বিশ্বাসঘাতকতা করল। লহার জাং পাস পেরিয়ে ওরা তেরাই পাহাড়ি জঙ্গল ছেরে আরও উপরে উঠতে লাগল। এখানে আর কন গাছ নেই। যত দূর চোখ গেছে শুধু ঘাস। এখানে গরম কালে গ্রামের লকেরা ছাগল চরাতে নিয়ে আসে। তারা এইখানেই থেকে যায়ে মাস দু মাস ছাগল ভ্যারার সাথে। এই হল বইদিনি বুগিয়াল। ওদের দুপুরের খাওয়া এখানেই হল। রান্নার আর পাঠ নেই স্রেফ গত কালের রাতের রুটি দিয়ে শিশির আচার। খাওয়ার পর কুয়ারি সিং স্টোব জালিয়ে ওদের গরম গরম চা খাওয়াল।সামনে হিমালয়ের পর্বত শ্রেণী – ত্রিশূল, নন্দা দেবী, ঙ্গ পর্বত – যেন হাত বারালেই ধরা যাবে, কিন্তু ওদের বসে থাকবার সময়ে নেই। বিকেলের মধ্যে পাথথর না চুনি পউছতে হবে। বইদিনি বুগিয়াল পার হতে রাস্তার ধারে কটা ছোট কুটির চোখে পরল। তার মধ্যে একটা পাথরের তইরি, ছট একটা দরজা, কোনও জানলা নেই – ওটা পাহাড়িদের তইরি। ছাগল চরাবার সময়ে রাতে ওরা ওখানেই থাকে। পাশের দুটো টিনের শেড – প্রকৃতির শোভা দেখার জন্য দুই দিকে জানলা – হাওয়া মহল – দেখলেই শীত করে।ওরা কিন্তু কনটাতেই থাকবে না – ওরা এগিয়ে চলল পাথথর না চুনির রাস্তায়ে।

বইদিনি থেকে পাথথর না চুনির পথ খুব সরু এবং অনেক জাগায়ে বেশ দুর্গম। এর পর থেকে  Permanent snowline শুরু হয়েছে। এর উপরে সারা বছর বরফে ঢাকা থাকে। আস্তে আস্তে ঘাসের চিহ্ন কমতে লাগল। ওরা প্রায়ে ১২০০০ হাজার ফুট উঁচুতে এসেছে। এখানে আর লকের বসতি নেই। এর পড় শুধু পাথর আর বরফ। টক্করকে খুব সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছিল। একে তো দুর্গম রাস্তা, তার উপর জুতটার ক্রমশ অবনতি হচ্ছে।কোনরকমে গুহাটা অব্ধি পউছতে পারলে হয়ে।

বেলা ৪টের পর ওরা পাথথর না চুনি পউছল। জায়গাটা নিবিড় ও নির্জন। চারিদিকে হিমালয়ের উঁচু শিখর স্থানটিকে ঘিরে।তারি মধ্যে যে পাহারের গা ধরে ওদের পথটা এসেছে, সেই পথ ছেরে অল্প উপরে পাহারের গায়ে একটা গুহা। বেশি বড় নয়, না জানলে হয়ত চোখেই পরত না টক্করের। গুহার ভেতরে ঢুকে দেখল যে ওরা ছয় জনের শোবার মতো জায়গা হয় যাবে। সারা দিন হেটে সবাই ক্লান্ত, স্লিপিং ব্যাগ খুলে ওরা শোবার তর জোর শুরু করে দিল। কুয়ারি সিং ইতিমধ্যে রাতের খাবার চড়িয়ে দিয়েছে – খিচুরি। এখানে কাঠের আগুন জ্বলবে না – অক্সিজেনের অভাব। তাই লন্ঠনের আলোতেই কিছুক্ষণ আড্ডা চলল।

“তদের সাথে আমি কাল রূপকুন্ড যাব না – আমায়ে ছারাই তোরা রূপকুন্ড ঘুরে আয়ে” হটাত বলে উঠল টক্কর।

সবাইয়ের প্রশ্নের উত্তরে সে তার হান্টার জুতটা তুলে ধরল।

“কি অবস্থা দেখছিস? কোনরকমে এত দূর পউচেছি, আবার এতটা রাস্তা ফিরতে হবে। গয়ালদামে ফিরলে একটা নূতন জোরা কেনা যাবে, কিন্তু তার আগে যদি এই জুতো ফেলে দিতে হয় – খালি পায়ে চলতে হবে। সাবধানের মার নেই – তোরা রূপকুন্ড দেখে আয়ে আমি ছবিতে দেখে নেব”।

সেই কথাই শেষে সবাই মেনে নিলো। কাল ভোরে বাকিরা এগিয়ে যাবে রূপকুন্ডের পথে। টক্কর থেকে যাবে গুহাতে। রুপকুন্ড থেকে ফিরে আস্তে ওদের দুপুর হয়ে যাবে। দুপুরে আবার গুহাতে খাওয়া দাওয়া সেরে ওরা নেমে যাবে থারলি পর্যন্ত। সবাই শুয়ে পরল। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা – লন্ঠনের টিমটিমে আল হচ্ছে – তাতে শীত কাটে না। টক্করের পাশে শোয়া স্মরও ফিস ফিস করল “ঠাণ্ডায়ে ঘুমতে পারছিস? আমি তো স্লিপিং ব্যাগের ভেতরে দুটো সোয়েটার পরে কাঁপছি।” বাকিদের সবার এক অবস্থা – সকলে শুয়ে দাঁত কপাটি খাচ্ছে। গুহার মুখটায়ে বসে বীর সিং আরে কুয়ারি নিজেদের পাহাড়ি ভাসায়ে গল্প করছে আর বিড়ি টানছে। ওরা পাহাড়ি লোক, শীতে অভ্যাস আছে, অতটা কষ্ট হয় না। শহুরে বাবুদের হাল দেখে বীর সিং একটু সমবেদনা দেখিয়ে বলল “বাবু লোগ কো বহুত সর্দি লগ রহা হায় – কই বাত নেহি – দেবী মা সব কা রাকশা করেগি – কাল আপকো রূপকুন্ড যারুর দর্শন হোগা।” তারপর যখন বুঝল ঠাণ্ডার চোটে ঘুমনোর কোন আশা নেই – ও জাগাটার একটা অদ্ভুত কাহিনী শোনাল।

মেয়েটি ছিল রূপে গুনে অসাধারণ

অনেক অনেক বছর আগের গল্প – লকের মুখে মুখে এ গল্পের প্রচার। এই এলাকায়ে ছাগল চরাতে আসত কাছের গ্রামের এক যুবতি মেয়ে। মেয়েটি ছিল রূপে গুনে অসাধারণ। ওর স্বভাব ছিল পাহাড়ি ফুলের মতো কোমল, ওর হাঁসি যেন পাহাড়ি নদী, ওর রূপ যেন ত্রিশূল পর্বতের গায়ে প্রথম সূর্যের ছটা। ওর জন্যে গ্রামের অনেক ছেলে দিওয়ানা – ওকে বিয়ে করবার জন্য দূর দূর থেকে আর্জি। কিন্তু মেয়েটার বাবা গ্রামের মোড়ল – একমাত্র কন্যা। তার বাবা কোন সমুন্দেই রাজি হতে চায়ে না। বাপের খুব গর্ব – কোন রাজপুত্র ছাড়া মেয়ের বিয়ে সে কিছুতেই দেবে না। ইতি মধ্যে সেই মেয়ে রোজ আসত এখানে ছাগলদের নিয়ে।সকালে এসে আবার বিকেলে আলো ফুরবার আগেই সে তার ঘরে ফিরে যেত। একদিন ঠিক এই গুহাটার কাছ থেকেই মেয়েটা নিখোঁজ হয়ে যায়। লোক লাগিয়ে অনেক খুঁজেও তাকে ফিরে পাওয়া যায় না। সবাই অনুমান করল কোন একটা দুর্ঘটনা হয়েছে – হয়ত কোন গভীর খাদে পরে তার মৃত্যু হয়েছে – তা ছাড়া কি বা হতে পারে – এখানে তো রাস্তা ঘাটে গুণ্ডা বদমাইশ ঘুরে বেড়াচ্ছে না, কলকাতা শহরের মতো, যে একটা ১৬ বছরের মেয়েকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যাবে। তা ছাড়া উঠিয়ে নিয়ে যাবেটাই বা কথায়ে। যাই হোক আসল সত্য আর কোনদিন উদ্ধার হল না। মেয়েটার করুন স্মৃতি লকের মুখে মুখে যেন এক রূপকথা হয়ে গেল। তবে আশ্চর্য ঘটনা হল এসবের পর। এই গুহার আশে পাশে লোকে কোন মেয়ের হাসির শব্দের গল্প করত। কেউ কেউ আবার বলল তারা যেন চুরির চুন চুন আওয়াজ পেয়েছে। দু একজন আবার এতটাও বলেছে যে তারা একটা মেয়েকে দেখেছে, গুহার উপর পাথরটায় বসে থাকতে। স্থানীয় লকের বিশ্বাস যে সেই মেয়েটার আত্মা পরী হয়ে গুহার উপর পাথরে এসে নাচে। এ থেকেই জাগাটার নাম পাথথর না চুনি – পাথরের পরী।

অদ্ভুত গল্প – বেশ লাগল টক্করের। অন্য জাগায় শুনলে হেসে উড়িয়ে দিত, এখানে এই গুহার ভেতরে মনে হল যে গল্পটা হয়ত সত্যি। বাইরে গুহার মুখটায়ে চাদের আলোতে চিকমিক করছে – টক্কর ঘুমিয়ে পরল।

পরদিন খুব সকালে বেরিয়ে পরল বন্ধুরা। টক্কর কিন্তু উঠল না – যখন উঠল তখন বেলা হয়ে গেছে। আজ ওর কোন তারা নেই। বন্ধুরা দুপুরের আগে ফিরবে না। এতটা সময়ে  করবেটা কি? একটু বাইরে বসা যাক – টক্কর বেরিয়ে এলো গুহার বাইরে। পাহারের ঢাল ধরে এগিয়ে বসলো একটা চ্যাপটা পাথর দেখে।বেশ ভাল রোদ পরেছে এই জাগাটাতে। খুব আরাম লাগছে টক্করের পাথরে বসে থাকতে। উপরের আকাশটা অদ্ভুত নীল। কোন মেঘ নেই।আকাশে অনেক উপরে – পাহারের চুড়ো গুলোর থেকেও আরও উপরে একটা পাখি হাওয়ার টানে টানে ভাসছে। নিশ্চয় ঈগল। অতো উপরে আর কোন পাখি উড়তে পারবে না। ঈগলটা ঘুরছে গোল করে, চারি ধার বরফে ঢাকা পাহারের চুড়ো আর সবের পেছনে সেই অদ্ভুত নীল আকাশ। টক্করের মনে হল ও যেন আর শরীরের মধ্যে নেই। মনে হল ওই যেন পাখি – মনে হল ওই যেন পাহাড়। পাহাড়, পাখী, আকাশ, জমিন সব মিলে মিশে টক্করের মনের মধ্যে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেলো।

একটা খিলখিল মেয়ের হাসির শব্দে টক্করের ঘোর কাটল। ঘুরে তাকাল – বড় পাথরটার আড়াল থেকে একটা মেয়ে তার দিকে তাকিয়ে মুখ ঢেকে হাসছে। এরকম সুন্দর মেয়ে সে কোনদিন দেখেনি – এরকম হাসি কোনদিন শোনেনি।একটুক্ষণ এক্কেবারে হুব্বা মেরে গেলো টক্কর। তারপর ভাবল নিশ্চয় গ্রাম থেকে উঠে এসেছে ছাগল চরাতে।

“তুমি কে? নাম কি?”

মেয়েটা উত্তরে শুধু হাসল।

“তমার ঘোর কথায়ে? তুমি কি নিচের গাঁ থেকে এসেছ?”

আবার সেই হাসি।

টক্কর বুঝতে পারল না এর পর কি করা উচিত। মেয়েটা কে? কোথা থেকে এলো? কিছুই পরিষ্কার নয় ওর কাছে। ওর প্রশ্ন শেষ হয়েছে দেখে মেয়েটা এবার হাত তুলে ওকে ইশারা করল।মেয়েটা ওকে ডাকছে – চোখে চোখে কোথা বলছে – আমার সাথে এস।পাহারের গাঁ ধরে মেয়েটা এগিয়ে গেলো। টক্কর ওর পেছনে। মেয়েটা যেন পাহারে-রি কন্যা – অতি দ্রুত তার গতি – তার পা যেন মাটি ছোয়ে না। টক্করের ওর সাথ তাল রাখতে দউরতে হচ্ছে। মেয়েটা দারিয়ে পরল এক জাগায়ে। সেখানে পাহারের গায়ে একটা চের পরেছে। পাথরের আড়ালে খাজ ঢাকা পরে আছে, হাজার লোক খুঁজলেও এ জাগা হয়ত পাওয়া যাবে না। সেই সরু খাঁজটাতে শরীরটা পাশ কাটিয়ে মেয়েটা পাহারের বুকে ঢুকে গেল। টক্কর এক মুহূর্ত দ্বিধা করল না, ও গেল মেয়েটার পিছনে।পাহারের ভিতরে হারিয়ে গেল দুজনে।

পাহারের ভিতরে হারিয়ে গেল দুজনে

অন্ধকার নয় মোটেই, বরং একটা গির্জার মধ্যে রঙ্গিন কাচের জানলা দিয়ে আলো ঢকে তেমনি পাহারের ফাঁক ফকর দিয়ে আলো ঢুকেছে জাগাতাতে।পাথুরে জমির উপর হাল্কা মসৃণ শ্যাওলার আবরণ – ভেজা নয় শুকনো – পায়ের তলায়ে ঠাণ্ডা নরম।অতি নির্জন এই গোপন স্থান – অতি নিবির অতি গোপন।মেয়েটা বসলো একটা পাথরের উপর, ওকে বসতে ইশারা করল পাশের পাথরে। অনেক কোথা হল ওদের। টক্কর বলল মেয়েটা কেবল শুনল, আর মাঝে মাঝে ওই পাগল করা মন মাতানো হাসি। টক্করের মনে হল মেয়েটা ওর সব কথা বুঝতে পারছে। জীবনে এত ভালো করে হয়ত আর কেউ বোঝে নি। সময়ে কেটে গলো পলকের মধ্যে। সকাল পেরিয়ে কখন দুপুর হয়ে গেল টক্করের খেয়াল হল না।

বাইরে চেনা গলার আওয়াজ, বন্ধুরা ফিরে এসেছে।

“ওরা ফিরে এসেছে, আমাকে খুঁজছে।”

মেয়েটা ওর দিকে চেয়ে আছে।

“আমি এখন যাই।”

সেই পাহাড়ি চোখে যেন এক নিবিড় ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে।

“আমি ফিরে আসব তুমি কথাও যেও না।”

মেয়েটা হাসল।

পাহারের খাজ পাশ কাটিয়ে – পাহাড়ের।গায়ে বেরিয়ে এলো টক্কর। জায়গাটা ভাল করে চিনে নেবার চেষ্টা করল।দুরে ওদের গুহার ময়ূখটা দেখা যাচ্ছে।স্মরও আর পার্থ বোস ওর দিকে পিট করে দারিয়ে। ওকে দেখতে পায়নি বন্ধুরা। টক্কর সেই লুকনো জায়গা ছেরে বন্ধুদের কাছে এগিয়ে গেল।

“কিরে টক্কর, কথায়ে উধাও হয়েছিলি?” পুঁছল স্মরও।

“রূপকুন্ড একটা অসাধারণ অভিজ্ঞতা – তুই মিস করলি।” বলল পার্থ।

“ওরে গুরু কইলু বিনায়কের মন্দিরে পূয চরিয়ে এসেছি, তোর নামেও ফুল আর বাতাসা চরিয়েছি – এই নে বাতাসা খাঁ।” পকেট থেকে বাতাসা বার করে দিল স্মারজিত। ওদের সবার মুখে অদ্ভুত যাত্রার গল্প। সবাই টক্করকে নিজের কাহিনী শোনাতে চায়ে। টক্কর বেশি কথা বলছে না, কেবল শুনছে আর বন্ধুদের আনন্দের অংশীদার হচ্ছে। পাহাড়ি মেয়ে, পাহাড়ে লুকনো জায়গা এসব কোনটার কথা বলল না বাকিদের কাছে।

গুহার ভেতরে সবাই ব্যস্ত। চটপট তল্পি তল্পা গুটিয়ে হাল্কা দুপুরের খাওয়া সেরে পথে বেরিয়ে পোরতে হবে। লহার জাং পউছতে হবে বিকেল পরার আগে। কুয়ারি সিং এর মধ্যেই খানা লাগিয়ে দিয়েছে – মাগী নুদেল আর টিন থেকে সুপ। অসাধারণ লোক এই কুয়ারি সিং, খালি হাতে আগুনের উপর রুটি শেকে খাইয়েছে এই লোকটা। সেই থারলি থেকে ওদের যাবতীয় খাবার মালপত্র বয়ে এনেছে পিঠে করে। সারাক্ষণ মুখে হাসি। রাস্তায়ে জংলি গাজার পাতা পেরে, সারা রাস্তা ডলে ডলে বিকেলে ওদের চরস বানিয়ে খাইয়েছে।

“শিব জি কা প্রাসাদ” – বোম ভোলানাথ।কাঠগুদামে ফিরে বুজু ওর বিলিতি বুট জরা কুয়ারিকে দিয়ে যাবে প্রতিজ্ঞা করেছে। পায়ের মাপ পর্যন্ত মেলানো হয়ে গেছে। কিন্তু যাক এসব কথা – আমাদের গল্প টক্করকে নিয়ে।

খাওয়ার পরে আর বসলো না ওরা। লম্বা সারি দিয়ে পথে চলতে শুরু করল ওদের দল। টক্করের রাকশ্যাকের স্ট্র্যাপ ঠিক করতে হল শেষ মুহূর্তে। তাই সবার পিছনে চলল টক্কর। এমনিতে সব শেষে আসে কুয়ারি সিং, কিন্তু ওদের দলের মাথায়ে আজ বীর সিং, তার পর বুজু, ওর পিছনে পার্থ, কুয়ারি, স্মরজিত আর সবের শেষে টক্কর। সাবধানে ওরা সঙ্কীর্ণ পথ ধরে পাহাড় থেকে নামা শুরু করল। আর কোনদিন হয়ত এই পথে ফিরবে না ওরা। টক্কর কান পেতে শুনল – ওটা কিসের আওয়াজ। ঠিক যেন একটা চেনা খিল খিল হাসির শব্দ। ঘুরে দেখল টক্কর – কেউ কথাও নেই।

তবে কি মনের ভুল? না – মনের ভুল নয়, ওই তো পরিষ্কার সেই হাসির আওয়াজ শোনা যায়। ঠিক যেন পাহারের ভিতর থেকে মেয়েটার হাসির শব্দ আসছে। মেয়েটা চলে যায় নি, অপেক্ষা করেছে টক্করের জন্য।টক্কর দারিয়ে পরল। মেয়েটাকে দেওয়া শেষ কথা ওর মনে পরে গেল, “তুমি কথাও যেও না, আমি ফিরে আসব।” না চলে গেলে হবে না, বেইমানি করা চলবে না, টক্কর বেইমানি করবে না। সামনে স্মরজিত অনেকটা এগিয়ে গেছে। পাহাড়ি রাস্তাটা সামনে বাক খেয়েছে, বাকি দলকে আর দেখতে পাচ্ছে না তক্কর।মেঘ আর কুয়াশা কখন এই পাহাড়টাকে ঘিরে নিয়েছে। সকাল বেলার পরিষ্কার রোদ্দুর মুছে গিয়ে পাহারটা এখন ধুওটে কুয়াশায়ে হারিয়ে যাচ্ছে। পাহারের ঢাল ধরে অল্প উপরে সেই লুকনো ফাটল। মেয়েটা অপেক্ষা করে আছে ওর জন্য। টক্কর যাবে তার কাছে, আবার দেখা করতে হবে তার,  আবার শুনতে হবে সেই মাদক হাসি। টক্করকে জেতেই হবে।

সামনে প্রায়ে ১০০ গজ দূরে স্মরজিত দারিয়ে পরেছে।”কি রে কি হল?” চেঁচিয়ে প্রশ্ন করল।

“কিছু না – জুতটা একটু শক্ত করে বাধছি। তুই এগিয়ে যা আমি আসছি।” হাঁটু গেরে বসে জুতোর দরি বাধার ভান করল টক্কর। স্মরজিত হাত তুলে সায়ে দিয়ে এগোতে থাকল। পাহারটার মোড় পেরিয়ে নিচে নেমে গেল স্মরও। ওদের কাউকেই আর দেখতে পাচ্ছএনা টক্কর। পাহাড় থেকে খিলখিল হাসির শব্দ আবার বেজে উঠল তার কানে।ওইত সেই জাগা যেখানে পাহারের ফাঁক দিয়ে পাহারের ভেতোরে জাওয়া যায়। ওদের নিবিড় লুকনো সেই জায়গা। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল টক্কর। পাহাড়ি কুয়াশার সাদা কাফনের  ভেতোরে পাথথর না চুনির সব কিছু হারিয়ে গেল।

21 comments

    • আপনার গল্পটা ভাল লেগেছে জেনে আমার খুব আনন্দ হচ্ছে। কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ। আরেকটা ভুতুরে গল্প টাইপ করলাম চুরুটের গন্ধ – আশা করি ভাল লাগবে।

      Like

  1. Surja

    You clearly have a flair for writing! And having personally known some of the protagonists in college makes reading them all the more enjoyable. Takkar’s reminiscence was especially touching since he is no more with us.

    The only bone I have to pick with are spellings and that might be just a question of getting a better transliterator or font.

    Keep at it!

    – Jayanta

    Like

  2. Buchu – gripping….agree with richa…..best bit……whentokkor is one with nature……he’s one with the mountains, bird and thesky……the feeling described was so magically precise :))

    Baba – khub romantic…. ek nishashe golpota shesh korlam…..apurba

    Ma – eto involvedhoen gechilam je laste jakhon tokkor jutor phite badche tokhon bhishon chintahochilo parir khpoppere na pore jaen aar shab sheshe jokhon kuashane dheke geloshab kichu tokhon hap chere bachlam!

    Like

Leave a comment