দুর্গা পূজার স্মৃতি

দুর্গা পূজা সব বাঙ্গালীর কাছেই প্রিয় – এই পূজার কথা লেখবার কোনও মানে হয় কিনা জানি না – আমার নিজশ্য কিছু ছেড়া  স্মৃতি অভিজ্ঞতা, এলো মেলো – মনের কোনায় লুকিয়ে আছে – এত কিছু মুছে গেছে এই স্মৃতিগুলি কেন মুছে যায়ে নি… জানি না।

আমার একেবারে প্রথম মনে পরে – তখন আমদের কেয়াতলার পুরনো বাড়ি ভাঙ্গা হয় নি – ছুটির সময় তিন চার দিনের জন্য আমরা রিষরা ছেরে কলকাতায়ে পূজা কাটাতে আসতাম – বাড়ি ভরতি লোক – অনেক কাকা পিসিরা এসেছে দেশের সব প্রান্ত থেকে, জয়পুর থেকে কুটটি জেঠু, বাঙ্গালর থেকে মনি জেটু, কুওেত থেকে সোন্দা জেঠু আর তাদের সাথে আমার সব জাত্তুথ পিস্তত ভাই বোনেরা। কেয়াতলা পারার আমাদের বাড়িটা খুব পুরনো, বাবারা ওই বাড়ীতেই বড় হয়েছেন। এক তলার দালানে পাচিলের উপর বল ছুড়ে নিজে নিজেই ক্রিকেট খেলছি। পূজার ষষ্টি হবে, পারার মাইকে সেই বছরের চালু গান…” …Monica o my darling….piya tu….”, গানের তাল জমাটি রেলের বাঁশি আর চাকার শব্দ সেই সময় ভাল লাগত কিন্তু জরে গাইবার সাহস হত না – জানি বকা খেতে হবে – অসভ্য ইঙ্গরাজি কথা – তখন মানে বোঝার বয়েস হয় নি, কিন্তু একটু অশ্লীলতার ছোঁয়া আছে গানের কথায় তা কারুকে বলে দিতে হয় নি।

ওই সময় থেকে আর একটা জিনিস মনে পরে , ক্যাপ পটকা, এখন পাওয়া যায় কি না জানি না। ক্যাপ গুলো হত লাল রঙের ছোট গোল আকারের, কাগজের চ্যাপ্টা গোল বাক্স বিক্রি হত। তার সাথে কিনতে হত ক্যাপ ফাটানোর নাট। লোহার তইরি তলার দিকে একটা বল্টু আর রডের গা থ্রেড করা (Threaded Bolt), তার উপর বসত গোল চ্যাপ্টা ওয়শার (Round Washer), বারুদের ক্যাপ যেত এই দুইয়ের মধ্যে। পুর জিনিসটা টাইট দিতে হত একটা নাট দিয়ে। তার পর আর কি… মারো জোরসে আছার মেজের উপর …ফটাস… দুম … দাম। পটকার আয়োয়াজে বাড়ী মাথায় তুলতাম। সারা দালান জুড়ে কালো কালো বারুদের দাগ করেছিলাম বলে বকা খেতে হয়েছিল মেজো জ্যাঠার কাছ থেকে। ছোটো বেলার কত কি অবাক লাগে – ঠাকুর দেখতে গিয়ে সব থেকে খুঁটিয়ে দেখতাম অসুরকে। তার মুখের ভয়ঙ্কর ভাব, পাকানো গোঁফ, কোঁকড়া কালো চূল, শরীরের শক্তিশালী পেশী – কোনটাই নজর এরাতও না আমাদের। পূয প্যান্ডেল, মা দুর্গার মুখ, সরস্বতী আর কার্তিকের পোস যতই ভাল হোক না কেন অসুর না জমলে ঠাকুর জমল না। রাতের বেলায় ঠাকুমর বিশাল খাটটাতে শোবার কাড়া কারী পড়ে যেত ছোটোদের। অনেক রাত পর্যন্ত ঠাকুমাকে অনেক উলটো পাল্টা প্রশ্ন আর গল্প শোণার পালা…। শোবাই মিলে দল কোরে অসুরকে মাড়াটা খুব অন্যায়ে – মা দুর্গা (দশটা হাত) + মস্ত সিংহ + ৪তে ছেলে মেয়ে + তাদের বাহন – বনাম – অসুর একা (Very Unfair). এই সব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুম এসে যেত জানি না।

আর বড় বয়েস তখন আমি কলেজে পরি – বাবা চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন – আমরা কলকাতার বারিতে চলে এসেছি। তখন আর পুরনো বাড়িটা নেই, সেই জাগায় নতুন ফ্ল্যাট বাড়ি হয়েছে। পারাতে অনেক ছেলেদের সাথে আলাপ হয়েছে – আমাদের রাস্তাতে চন্দন – বাবুয়ারা আড্ডা মারে, সুভাসদার দোকানের সামনে আর একটা আড্ডা বসে, তারা একটু বয়েসে বড়, আবার লেক ক্যাম্পের ছেলেরাও আছে – মোটমাট বন্ধু বান্ধবের অভাব নেই। সন্ধ্য বেলাতে পূজা মণ্ডপ জমজমাট – আরতি আর তার পর ধুনিচি নাচের প্রতিযোগিতা – ১০০০ টাকা প্রথম পুরস্কার – অনেক নাম করা সব নাচিয়ে আসত নাচ দেখাতে। ঢাকির তালে তালে, দ্রুত আর দ্রুত হয় উঠত তাদের নাচের গতি। পায়ের সঙ্গে পরত ঘুঙ্ঘুর, গলায় জবা ফুলের মালা। ধুনুচির ধুয়ে ভরে যেত প্যান্ডেলের ভেতরটা। আমি একবার নেচেছিলাম – দেখতে সোজা হলেও নাচটা সহজ নয় – কল্কে থেকে আগুন না ফেলে হাত ঘুরাবার এক পধতি আছে। কল্কের ধারটা খুব গরম হয় যায়, সেই গরম কল্কের ছ্যাকার দাগ আমার হাতে আজও আছে। মা দুর্গার কৃপাতে পাকামি করে তৃতীয় কল্কেটা মুখে নেবার চেষ্টা করি নি।

ওই সময় মনে পরে আমাদের একটা রেয়াজ চালু হয়ছিল – সারা রাত ধরে পায়ে হেটে পূজা দেখা। পিস্তত, খুরতত ভাইদের নিয়ে বেরিয়ে পরতাম অষ্টমীর রাত ১০টা নাগাত খাওয়া সেরে। সোজা গিয়ে চরতাম গোল পার্ক থেকে ছারনেওয়ালা L-9 বাসের দুতলায়। গিয়ে নাবতাম একেবারে শ্যামবাজার পাচ মাথার মোরে। বুব্লা ছিল আমার থেকে ১-২ বছরের ছোট, ওর রাস্তার গ্যান সবার চেয়ে ভাল তাই ওর পকেতে থাকত ডানলপের পূজা রোড ম্যাপ। তারপর সুরু হত হাটা – কোনও পূজা বাদ পরত না – আহিরিতলা, সিমলা ব্যায়াম, বাগবাজার ঘুরতে ঘুরতে শেষে পউছাতাম চৌরিংগী – ওখান থেকে বাস নিয়ে কালীঘাটে পৌঁছে ওই দিককার বড় বড় পূজা গুল দেখতাম – ২৩ পল্লি, শঙ্ঘস্রি, তার পর হাঁটতে হাটতে পারার কাছি এসে পরতাম – বালিগঞ্জ কালচারাল, সমাজসেবী, একডালিয়া, শেষে আর যখন পা চলে না তখন তেকন পার্কে বসে পরতাম কফি খেতে আর শেষ সিগারেটটা টানতে। বাড়ি ঢুকতে সকাল হয় যেত, কোনও মতে একটা ফাকা বিছানা দেখে কম্বল টেনে ঘুম লাগাও দুপুর পর্যন্ত।

আমাদের কেয়াতলা পাড়ার পূজার আর দুটো ঘটনা মনে পরে – এক হল পূজা শুরুর আগে কুমারটুলি থেকে ঠাকুর আনতে যাওয়া। আমি মফশালে বড় হয়েছি তার আগে কুমারটুলি থেকে ঠাকুর আনবার অভিগ্যতা নেই। অভিজ্ঞতা নেই কিন্তু উৎসাহ ভরপুর। দুটো লরি ভারা হয়েছে পাড়ার সব ছেলেদের সাথে চরে পরলাম লরির পিঠে। হই হই করা ছাড়া আর কোন দায়িত্ব দেওয়া হয় নি আমাদেরকে। আসল কাজ করবার জন্যে পাড়ার বররা ছিল – আমরা খালি বল দুর্গা মাই কি – জয় সারা জাগাতে জাগাতে সারা শহরকে জানান দিতে দিতে কুমারটুলি পউছালাম। অররেবাস লরির কি ভিড়! আমাদের ঠাকুর তুলতে তুলতে প্রায়ে রাত ২টা বেজে গেল। তারি মধ্যে বেশ কয়েকটা হাতাহাতি, একটা বেশ সিরিয়াস – একটা লরিতে ঠাকুর তুলতে গিয়ে পরে গেছে – একটা ছেলে বেধড়ক মার খাচ্ছিল – লোকাল ছেলে (কারিগরের হেল্পার) – যারা পিটাচ্ছে তারাও লোকাল – বুঝলাম লরিতে তোলা পর্যন্ত কারিগরের দায়িত্ব, একবার উঠে গেলে পাড়ার দায়িত্ব। শেষে ওদের পাড়ার ছেলেরাই বাচিয়ে দিল – মারধর করে কি হবে, ইচ্ছে করে তো করে নি, ভুল হয় গেছে – আচ্ছা তোমরা ঠাকুর সারিয়ে দিয়ো, আমরা কাল এসে নিয়ে যাব। আমাদের ঠাকুর যদিয়ও ঠিক ঠাক পৌঁছে গেল। পারাতে পৌঁছে নামাবার সময় যথা রিতি সুভাসদার চিৎকার চ্যাচামিচি -“আরে তোরা মাজাটা কেউ ধর… ধর ধর ঠিক করে … আচ্ছা এবার সামলে ঠাকুর নামা …” বল দুর্গা মাই কি – জয়।

আর মনে পরে ঠাকুরের সাথে ভাসান যাওয়া – লরির পিছনে নাচতে নাচতে। ওই দিন অনেকেই মদ খেত আর প্রতি বছর কেউ না কেউ লরি থেকে মালের ঘরে পা হরেকে পরত – প্রতি বছর। নাচতে নাচতে পৌঁছে যেতাম গোল পার্ক ঘুরে, বালিগঞ্জ ধরে দেশপ্রিয় পার্ক পর্যন্ত। তার পর লরিতে উঠে পর – লরি ছুটবে বাবু ঘাট সেখানে ভাসান। ওই নাচানাচির মধ্যে কেউ পাশের বারির কুণালকে পিঠে খুর মেরেছিল। ও নিজেও বুজতে পারে নি, অন্য কেউ বলে দিল শার্ট টা লাল কেন – রক্তের দাগ – কে মারল তোকে ? মেরে পালিয়ে গেছে – শালা পুরনো খার ছিল হয়ত কারও। কুণালকে বাড়ি নিয়ে গেল দুএকজন বন্ধু মিলে। পরে শোলটা সেলাই দিতে হয়ছিল বেচারাকে…। বল বল দুর্গা মাই কি…। জয়।

8 comments

Leave a comment